গল্পের নাম: **রাস্তার দ্বন্দ্ব**



পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম করিমপুর। এখানে অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে, এবং জমির চাষাবাদই তাদের প্রধান আয়ের উৎস। গ্রামের মানুষ শান্তিপ্রিয় হলেও মাঝে মাঝে জমির সীমানা বা রাস্তা নিয়ে তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায়। ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল আবুল মিয়া আর করিম মিয়ার মধ্যে।


আবুল মিয়া ছিলেন গ্রামের এক প্রভাবশালী মানুষ। তাঁর বসতবাড়ির সামনের জমি দিয়ে একটি ছোট রাস্তা ছিল, যা দিয়ে করিম মিয়ার বাড়ি যাওয়া আসা করতে হতো। করিম মিয়ার বাড়ির পাশে কোনো পাকা রাস্তা ছিল না, তাই গ্রামের ছোট মাটির পথ দিয়েই তার চলাচল করতে হতো। করিম মিয়া এই রাস্তা ব্যবহার করে বছর বছর ধরে আসছেন, এবং আবুল মিয়া প্রথমে কোনো আপত্তি করেননি। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন আবুল মিয়া রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মনে করলেন, করিম মিয়া বিনা অনুমতিতে তার জমির ওপর দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করছে, যা তার জন্য সম্মানহানিকর।


একদিন করিম মিয়া সকালে উঠে দেখেন, আবুল মিয়া তার জমির অংশে বাঁশের বেড়া দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন। করিম মিয়া প্রথমে কিছুটা অবাক হন, কারণ এত বছর ধরে এই রাস্তা তিনি ব্যবহার করে আসছেন। তিনি আবুল মিয়ার কাছে গিয়ে বললেন, "ভাই, এই রাস্তাটা তো আমি বহু বছর ধরে ব্যবহার করে আসছি। আপনি হঠাৎ করে এটি বন্ধ করে দিলেন কেন?"


আবুল মিয়া কঠিন স্বরে বললেন, "এই জমি আমার, আর এই রাস্তা আমার জমির মধ্য দিয়ে যায়। তুই আমার অনুমতি ছাড়া এই রাস্তা ব্যবহার করতে পারবি না। তুই নিজের জমি দিয়ে আলাদা রাস্তা বানিয়ে নে।"


করিম মিয়া কষ্ট পেয়ে বললেন, "ভাই, আমার তো আর কোনো রাস্তা নেই। আপনি যদি এই রাস্তা বন্ধ করেন, তবে আমি বাড়ি থেকে বের হতে পারব না। এভাবে আপনার জমি দিয়ে বহুদিন যাবত চলাচল করছি, কোনোদিন তো সমস্যা হয়নি।"


আবুল মিয়া আরও কঠোরভাবে বললেন, "যা বলেছি, তাই। এই রাস্তা তুই আর ব্যবহার করতে পারবি না।"


এই কথোপকথনের পর করিম মিয়া অত্যন্ত বিরক্ত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে ফিরে গেলেন। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, এই ব্যাপারটি মিটিয়ে নিতে হবে। কিছুদিন পর করিম মিয়া কিছু শ্রমিক নিয়ে এসে রাস্তার পাশের বেড়া ভেঙে ফেলে তার পথ পরিষ্কার করে নেয়। এই ঘটনা জানার পর আবুল মিয়া ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে আসেন এবং করিম মিয়াকে মারধর করতে উদ্যত হন।


দুইজনের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে আবুল মিয়া লাঠি তুলে আঘাত করেন করিম মিয়াকে। করিম মিয়া তৎক্ষণাৎ একটি বাঁশ তুলে আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করেন, এবং শুরু হয় ভয়াবহ মারামারি। গ্রামের লোকজন এই ঘটনা শুনে ছুটে আসে, কিন্তু ততক্ষণে দু’জনেই রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তাদের দুজনকে কোনোভাবে থামিয়ে গ্রামের লোকেরা আলাদা করে দেয়।


গ্রামের মোড়ল এই ঘটনার বিচার করার জন্য সবাইকে একত্রিত করেন। মোড়ল বলেন, "তোমরা কি বুঝতে পারছ না, জমির রাস্তা নিয়ে এই মারামারি তোমাদের দুজনকেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে? এভাবে যদি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করো, তাহলে তোমাদের পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"


তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, জমি মাপজোখ করে দেখা হবে আসলেই রাস্তার মালিকানা কার। পরের দিন একজন ভূমি কর্মকর্তা এসে জমি মাপজোখ করলেন এবং দেখা গেল, সেই ছোট রাস্তাটি আসলে গ্রামীণ রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত, যা বহু বছর ধরে গ্রামের সবাই ব্যবহার করে আসছে। এই রাস্তা কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, বরং সবাই মিলে এটি ব্যবহার করতে পারে।


এই রায়ের পর আবুল মিয়া কিছুটা লজ্জিত হন এবং বুঝতে পারেন যে, তার জমির ওপর দিয়ে গ্রামের রাস্তা চলে যাওয়াটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। তিনি করিম মিয়ার কাছে গিয়ে বলেন, "ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে। এত ছোট একটি ব্যাপার নিয়ে আমাদের এত বড় ঝগড়া করার প্রয়োজন ছিল না।"


করিম মিয়াও মাথা নিচু করে বলেন, "না ভাই, আপনিও ক্ষমা করবেন। আমিও তাড়াহুড়ো করে রাগের মাথায় বেআইনি কাজ করেছি।"


দু'জন পরস্পরকে ক্ষমা করে আবার বন্ধুত্বপূর্ণভাবে মিলেমিশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তারা বুঝতে পারল যে, জমির মতো বিষয় নিয়ে ঝগড়া করলে শুধু সময়, শক্তি, আর সম্পর্ক নষ্ট হয়, আর কিছুই লাভ হয় না।

Comments